সুবিস্তৃত এবং তরঙ্গ সংকুল অসংখ্য নদী, নিবিড় দুর্ভেদ্য জঙ্গল, ভীষণ হিংস্র জন্তু সমুহের অত্যাচার, প্রতিনিয়ত
জল প্লাবনের কর্দমাক্ত ভূ-পৃষ্ঠ, আবাস আশ্রয় বা
ভ্রমণচিন্হিত পথের অভাব এবং আরও শত প্রকার উৎপাত সুন্দরবনকে মানুষের পক্ষে অগম্য
করিয়া রাখিয়াছে... সুন্দরবনে ভ্রমণকারীকে সৈনিকের মত জীবন যাপন করতে হয়। প্রায় ৬০ বছর আগে এরূপ মন্তব্য করেছেন সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ শ্রদ্ধেয়
সতীশচন্দ্র মিত্র। এ দীর্ঘ সময়ে পদ্মা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। সুন্দরবন আর অগম্য নয়। বরং মানুষের
নিত্যদিনের অত্যাচারে সুন্দরবন তার সৌন্দর্য তথা অস্তিত্বই হারাতে বসেছে।
জ্বালানীর প্রয়োজনে, বাসস্থানের প্রয়োজনে সারা বিশ্বে বর্তমানে বছরে ৪০
হাজার বর্গমাইলেরও বেশী বন জঙ্গল ধ্বংস করা হচ্ছে;পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ
এলাকা বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। একটু একটু করে
প্রতিদিনই সুন্দরবনকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এক সময়ের পুরো
গাঙ্গেয় মোহনা জুড়ে থাকা সুবিশাল সুন্দরবন দুই বাংলা মিলে মাত্র ১০ হাজার
বর্গকিলোমিটারে দারিয়ে। বাংলাদেশের অংশে সুন্দরবনের পরিমাণ বর্তমানে ৫ হাজার ৭শত
৭০ বর্গ কিলোমিটার মাত্র।
আজ যে সুন্দরবন অঞ্চল জনহীন মহারণ্য, পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ
শতক পর্যন্ত সেখানে ছিল ঘনবসতিপূর্ণ সমৃদ্ধ জনপদ। প্রকৃতির ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যে দিয়ে কখনও সমৃদ্ধ জনপদ আবার বনভূমিতে
রূপান্তরিত কিংবা নদী ও সাগরগর্ভে বিলীন হয়েছে। এইভাবে সুন্দরবন প্রত্যক্ষ করেছে বহু রাজশক্তির উত্থান-পতন।
শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল সুন্দরবনে বেড়াতে যাবার উপযোগী সময়। ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে মংলা পর্যন্ত সড়ক পথে, মংলা থেকে কোন জলযানে সুন্দরবন।
সুন্দরবনের অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্য, অরণ্য, সমুদ্র,
বৈচিত্র্যপূর্ণ উদ্ভিদ, প্রাণীকুল
মানুষকে প্রতিনিয়তই টানে। সুন্দরবনের
কথা মনে হলেই মোহন সুন্দর ভয়ংকর বাঘের ছবি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। বাঘের পরই যার চকিত চপল চাহনি মনকে ভরায় সে হরিণ। বাঘ-হরিণ, কুমির-হাঙ্গর, বানর-মৌমাছি, চিংড়ি মাছ সুন্দরবনের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছে। ‘পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে-বনে বনে হরিণের চোখে/হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্ত
আলকে’। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থান বলে সুন্দরবন এলাকা লবণ
পানিতে প্লাবিত। জলে লবনাক্ততার পরিমাণ ও অরণ্য সম্পদের প্রকৃতির নিরিখে
সুন্দরবনকে মুলতঃতিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। নোনা পানির
অঞ্চল(পশ্চিমাংশ), কম নোনা অঞ্চল(মাঝের অংশ), এবং মিঠা পানির অঞ্চল(পূর্বাংশ)। বাঘ সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ। যত ভয়ংকর ও
হিংস্র হোকনা কেন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণকারীরা সুন্দরবনে ছুটে যান বাঘের
দর্শন লাভের আশায়।
ইতালির একটি দল সুন্দরবন অভিযানের মাত্র ২ সপ্তাহ আগে
‘বাংলাদেশ অবজারভারে’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘সুন্দরবনের সম্পদরাজি লুটপাট করা হচ্ছে’-প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, যথেচ্ছ নিধনের ফলে সুন্দরবনের অমূল্য
সম্পদ, জাতির গর্ব বাঘের বংশ নির্বংশ করা হচ্ছে। প্রতিবেদক যদিও তাঁর প্রতিবেদনে বর্তমানে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৬’শত
বলেছেন, খুলনা অফিসের সহকারী বন কর্মকর্তা এই
সংখ্যাকে অতিশয়োক্তি আখ্যা দিয়ে বলেছেন, সুন্দরবনে প্রকৃত
বাঘের সংখ্যা এর অর্ধেকের মত হবে। ১৯৮৩ সনে
বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত সর্বশেষ বাঘ জরীপের রিপোর্টে বাঘের সংখ্যা সাড়ে তিনশত বলে
উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে ধারণা করা হয় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা প্রায়
দুইশত।
সুন্দরবনের অবশিষ্ট কয়েকটি প্রাণীর অন্যতম বাঘ যদি এই
জংগলের গর্বের বস্তু হয় তবে এটি নবীন বাংলাদেশেরও গর্বের বস্তু। বাংলাদেশের কাগজী মুদ্রায় বাঘের সুন্দর জলছাপ সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাংলা লোকসাহিত্যে বাঘকে নির্বোধ দুষ্টু প্রকৃতির প্রাণী
হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর কিছুটা
কারণ বোধহয় প্রায়শইঃ এর বেঘোরে প্রাণ হারাবার ঘটনা। কাস্পিয়ান সাগর থেকে ইন্দোনেশিয়া জুড়ে একসময় বাঘের আবাস ছিল। ১৯৭০ সালে কাস্পিয়ান সাগর এলাকার শেষ বাঘটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশই এখন বাঘের আবাসভূমি। যদিও চিন, নেপাল এবং রাশিয়ায় গোটা কয়েক বাঘের অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান। মানুষের উৎপাত-অত্যাচারে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে রাজকীয় যে বাঘ একদিন
সুন্দরবনের মত তৃতীয় শ্রেণীর জংগলে(বাঘের জন্য)আশ্রয় নিয়েছিল তাও আজ বিলুপ্তির পথে।
ভারতীয় উপমহাদেশের জনসংখ্যা ফি বছরে ২’শতাংশ হারে বেড়ে
চলছে কাজেই খুব শিগ্রই বাঘ, হাতি, গণ্ডারের মত প্রাণীদের থাকার আর কোন
জায়গা অবশিষ্ট থাকবেনা। কেবলমাত্র
শহরের চিড়িয়াখানায় লোহার খাঁচায়ই এদের দেখা পাওয়া যাবে। বিশ্বের বৃহত্তম পারাবন বা ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের নামকরণটি বেশ মজার। এ অভয়ারণ্যে ‘সুন্দরী’ গাছের আধিক্য থাকার কারণে এর নাম ‘সুন্দরবন’ হয়েছে
বলে অনেকে মনে করেন। দেখতে সুন্দর হওয়ার কারণেও ‘সুন্দরবন’ নাম হয়েছে এ
ধারনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুন্দরবন
এলাকার লোকজন এই জঙ্গলকে ‘বাদা’ বলতে অভ্যস্ত। সুন্দরি, কেওড়া,
গড়ান, বাইন প্রভৃতি গাছ মাটি ফুঁড়ে বের
হওয়া মূলের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালায়।
প্রকৃতির এক অসাধারণ লীলাভূমি সুন্দরবন। সুন্দরবনে প্রায় ৩০ প্রজাতির গাছপালা বিদ্যমান। ২৭০ প্রজাতির পাখি, ১২০ প্রকারের গাছ, ৪২ প্রজাতির হিংস্র জাতীয়
প্রাণী, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীতে
পরিপূর্ণ এই জঙ্গল। গোটা
সুন্দরবনের এক-তৃতীয়াংশ নদী-নালা-খাল-বিলে পরিপূর্ণ।
সুন্দরবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ মাছরাঙা যে কোন ভ্রমণকারীর মন
কাড়বে। ষটর্ক বিল্ড, ব্রাউন-উইং, হোয়াইট-কালার্ড,
ব্ল্যাক কে পড, কমন কিং ফিঙ্গার,
রুড কিং ফিশার যত্র-তত্র দেখতে পাওয়া যায়। চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে সুন্দরবনের গাছে গাছে ফুল ফোটে বলে মৌমাছি চাক
বাঁধে। এ সময় বিশেষতঃ সাতক্ষীরা অঞ্চলের লোকজন তিনমাস মধু
সংগ্রহের পেশা গ্রহণ করে। এদের বলা হয় মউলে।
ছোট ছোট গাছ-গাছড়াও কমতি নেই সুন্দরবনে। বড় জাতের গরান, সুন্দরী, কেওড়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে বেড়ে ওঠে
এসব লতাগুল্ম, নোনা পানির জংগলের ভেতর বা এসবের আশে পাশেই
দেখা যায়।
সুন্দরবন দেখার জন্য সাগর পাড়ের কোন জঙ্গলই নির্বাচন করা
উচিত। সমুদ্র সৈকতের মত এসব এলাকায় হাঁটা-চলায় যেমনি
স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা যায়, তেমনি জন্তু-জানোয়ার, বিশেষ করে হরিণের
সাক্ষাত পাওয়া যায় এসব এলাকায় সহজেই। টাইগার পয়েন্ট, কটকা, কচি-খালি,
নীলকমল, তিনকোণা দ্বীপ, মাদা-বাড়িয়া এসব এলাকার মধ্যে স্থান নির্ধারণ করলে উপরোক্ত সুবিধাসমূহ
অনায়াসে পাওয়া যাবে।
সুন্দরবন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আপনার সারাজীবনের পাথেয় হয়ে
থাকবে। এ মোহনীয় সুন্দর অরণ্য দর্শনে তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম
দরিদ্র বাংলাদেশের গ্লানি কিছুটা হলেও আপনার ঘুচবে। প্রতিদিন যে হারে এই অসম্ভব সুন্দর
অরণ্যকে ধ্বংস করা হচ্ছে, নিজের চোখে তা দেখে আপনার মন ব্যথায় ককিয়ে উঠবে। বার বার ফিরে যেতে মন চাইবে প্রকৃতির গড়া অসীম আর সসীমের সে মিলন মোহনায়।
সুন্দরবনের
তথ্য কনিকাঃ
অবস্থানঃ খুলনা, বাগেরহাট
ও সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণাংশ জুড়ে আয়তন ৫৭০০ বর্গ কিলোমিটার। নদীনালা ১৭০০
বর্গ কিঃ মিঃ বনবিভাগের খুলনা বিভাগীয় বন অফিস হতে এর
তত্ত্বাবধান করা হয়। রেঞ্জ অফিসের অধীনে মোট ১২ টি ষ্টেশন অফিস রয়েছে। এছাড়া বনের মধ্যে কুপ অফিস/ভাসমান অফিস রয়েছে।
শরণখোলাঃ
ষ্টেশন-সুপতি, বগী, কচি-খালি, কটকা, হরিণ-টানা, চান্দেশ্বর, দুধমুখী;
চাঁদপাইঃ
ষ্টেশন-ধানসাগর, জিউধরা,
ডাংমারী, মৃগমারী, বৈদামারী, সূর্যমুখী, করমজল, জোংরা।
নলিয়ানঃ
ষ্টেশন- সুতারখালী, কালাবগী,
বানিয়াখালী, কাশিয়ারদি, খামিটানা, জোশিং।