চয়ন আর লিজা একসাথে রিক্সায় করে
যাচ্ছে। চয়ন লিজাকে বলল “মনে আছে তো
কখন,
কাকে কি বলবি?
--হুম। কিন্তু এটা কি ঠিক হচ্ছে?
--আমি অনেক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মা বা ঋতু কিছু বললে কিছু মনে
করিস না।
--এটা আমাকে বলতে হবে না।
রিক্সাওয়ালা হঠাৎ করে বলে উঠলো “মামা, নতুন বিয়া করলে পরথম
পরথম বাড়ির লোগজন মাইন্যা লয় না। তয় কয়দিন পরে ঠিকি মাইন্যা লয়” চয়ন বুঝতে পারলো
রিক্সাওয়ালা লিজার পোশাক ও
সাজ-সজ্জা দেখেই এই মন্তব্য করেছে। অন্য সময় এই কথা শুনে হয়তো চয়ন হেসে ফেলতো।
কিন্তু এখন হাসলো না। হাসতে পারলো না। সে বলল
“আপনাকে নাক গলাতে হবে না। আপনি রিক্সা চালান”
বাসার সামনে আসতেই চয়ন রিক্সা দাড় করিয়ে
রিক্সা-ভাড়া মিটিয়ে দিলো। সিঁড়ি
দিয়ে উঠতে চয়ন লিজাকে বলল “একটু সামলে নিস”।
লিজা শুধু অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো “হুম”
দুবার কলিং-বেল চাপার পর ঋতু সবসময়ের মতো দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলো। ঋতু মনে হয় সবসময় অপেক্ষায় থাকে কখন দুপুর দেড়টা বাজবে আর
চয়ন বাসায় আসবে। দরজা খুলেই চয়নকে দেখে বলল
“আসছো”। কিন্তু পরমুহুর্তেই লিজাকে দেখে
স্তব্ধ হয়ে গেলো। চয়নের মা রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলো “ঋতু, কে রে?” দরজায় এসে লিজাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। লিজা চয়নের মাকে দেখার সাথে সাথে সালাম করলো। চয়নের মা বিস্মিত হয়ে
চয়নকে জিজ্ঞেস করলো “এ কে? আর সালামই বা করছে কেন?”
চয়ন বলল “বলছি। আগে তো ভিতরে যেতে দাও!”
ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে চয়ন
লিজাকে দেখিয়ে তার মাকে বলল “তোমার বউ
মা” চয়নের মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।
সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! এটা কিভাবে সম্ভব! পাশে দাঁড়ানো ঋতুর মাথা ঘুরছে। চয়নের মা বুঝতে পেরে
ঋতুকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলো। ঋতুর মনে হচ্ছে এটা কিভাবে সম্ভব! মনে হচ্ছে কেউ একজন
তার হৃদপিন্ডটিকে ধারালো ছুরি দিয়ে খোঁচাচ্ছে। সে কাঁদতে
চাইছে না। কিন্তু চোখের পানি আর বাঁধ মানতে চাইছে না। তার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন
“এটা কিভাবে সম্ভব?” পাশে লিজা অপরাধীর মতো নতমুখে দাড়িয়ে
আছে। তার খুব ইচ্ছা করছিলো চয়নের মা আর ঋতুকে সত্যিটা বলে দেবে। বলবে “চয়ন আর লিজা
স্বামী-স্ত্রী নয়। এ সবই অভিনয়” কিন্তু সেটা সম্ভব না। সে চয়নের মুখের দিকে চেয়ে
দেখলো, চয়ন আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে স্বাভাবিক
রাখার। কিন্তু তার মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। কষ্টের ছাপটা লুকানোর জন্যই হয়তো মাথা
নত করে আছে। ড্রয়িংরুমে এই মুহূর্তে
পিনপতন নীরবতা। শুধু ঋতুর চাপাকান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। নীরবতাকে কাঁচের ভেঙে পরা
খান-খান শব্দের মতো করে চয়ন বলে উঠলো “ওর নাম লিজা। ভার্সিটিতে পড়ার শুরুর দিকে
লিজাকে দেখে ভালোবেসে ফেলি। কিন্তু তখন ও পাত্তা দিতো না। এখন রাজী হওয়ায় বিয়ে করে
নিয়ে আসলাম”। ঋতু উঠে গিয়ে চয়নের হাঁটুতে
হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল “চয়ন, তুমি আর মজা করো না। এগুলো সব মিথ্যা”। চয়ন বলল,
“আরে আজব! মিথ্যে হবে কেন? কিছুক্ষণ
আগেই আমরা কাজী অফিসে বিয়ে করেছি”। ঋতু কাঁদতে কাঁদতে বলল “তুমি আমার সাথে এভাবে প্রাতরনা করতে
পারো না” চয়ন সবাইকে অবাক করে ঠাস করে ঋতুকে চড় দিয়ে বলল
“আমাকে প্রতারক বলছো। আমি তোমার সাথে কি প্রতারণা
করেছি?”
চয়নের মা উঠে এসে চয়নকে ঠাস-ঠাস করে কয়েকটা চড় দিয়ে বলল “কুলাঙ্গার কোথাকার! আমি ভাবতে পারছি
তোর মতো একটা পশুকে আমি পেটে ধরেছি। ফুলের মতো মেয়েটাকে তুই আঘাত করছিস!” চয়ন বলল “তুমি একটা পরের মেয়ের জন্য আমার গায়ে
হাত তুললে?”
চয়নের মা বলল
“ঋতু পরের মেয়ে না। ও আমার মেয়ে। আমি ওকে পেটে ধরি নি, কিন্তু ও আমাকে মা বললে আমি গর্ববোধ করি। কিন্তু তোর মতো পশু আমাকে মা
বললে আমি অপমানিত বোধ করি। তুই আমার সামনে থেকে চলে যা। জীবনে আমার সামনে আসবি না।
আমি তোর কুকুরের মতো মুখ দেখতে চাই না। কখনো আমার সামনে আসলে আমার মরা মুখ দেখবি
না”। চয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
“যদি তুমি তা চাও,
তবে তাই হোক”। চয়ন লিজার হাত টেনে নিয়ে বের হয়ে গেলো। ঋতু চয়নের
মায়ের কোলে মাথা রেখে অঝর ধারায় কেঁদে চলেছে আর চয়নের মা নির্বাক-ভাবে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চলছে....
চয়ন বিছানায়
শুয়ে আছে। শেষ বিকেলের রোদ জানালা দিয়ে এসে দিনের শেষ জানিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ
পরেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। সূর্য ডুবে যাবে। মানুষের জীবনটাও
এরকম। শুরু হয় নরম,
স্নিগ্ধ আলো দিয়ে। দুপুরে অর্থাৎ
যৌবনে উজ্জ্বল। আর শেষ বিকেলে সন্ধ্যের জন্য
অপেক্ষা। কিন্তু চয়ন ভাবছে দুপুরেই কেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে
আসে। যদি দুপুরেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে
আসে,
তবে সবার জীবনে কিরকম দুর্ভোগ নেমে আসবে। এসময় লিজা চা নিয়ে
আসলো। চা দিতে দিতে চয়নকে জিজ্ঞেস করলো “মন খারাপ?” চয়ন বলল “মন খারাপ না হওয়াটা কি অস্বাভাবিক না?”
--হুম।
--আর মন খারাপ করে কোন লাভ আছে। অনিবার্য পরিণতি মেনে না নিলে কি সেই
পরিণতি পিছু হটবে। তাকে বরণ করে নিতেই হবে। (চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে) বাদ দে। তোর
বর কোথায়?
--বাজারে গেলো। আচ্ছা, একবার চেষ্টা করা যায় না।
দেশে এখন অনেক ভালো ডাক্তার আছে। তুই বিদেশেও যেতে পারিস।
--এটা সাধারণ
সর্দি-জ্বর না যে ডাক্তারের কাছে গেলাম, প্রেশক্রিবশন করলো,
ওষুধ খেলাম আর সুস্থ হয়ে গেলাম। এটা ব্লাড ক্যান্সার। তাও মিডিল
স্টেজ। চান্স ৪০%।
--(কাঁদতে কাঁদতে) তাও যদি...
--ধুর পাগলী। কাঁদছিস কেন? আমি মনে হয় আজই মারা
যাবো। হা হা হা...
--অভিনয় করবি না। আমি জানি তোর কতোটুকু কষ্ট হচ্ছে।
--আমার কষ্ট হচ্ছে মা আর ঋতুর জন্য।
--ওরা কি কষ্ট পেয়েছে জানিস!
--আমার ব্লাড ক্যান্সার জানলে আরো বেশি কষ্ট পেতো। দুজনই হয়তো আত্মহত্যা
করতো। এখন হয়তো আমাকে ঘৃণা করবে, তবে বেঁচে থাকবে।
--আন্টির কি হবে?
--ঋতু আমার
চেয়ে বেশি মাকে ভালোবাসে। জন্মের পর কখনো বাবা-মার আদর পায় নি তো। ইশ... এতিম
মেয়েটা। ও কখনো মাকে ছেড়ে যাবে না। ওর মামা-মামীর কাছ থেকে এনে মা নিজের কাছে রেখে
দিলো। আমাদের বিয়ে দিলো না। বলল
আগে নিজের পায়ে দাড়া,
তারপর বিয়ে। ব্যবসা দাড় করালাম। কিছুদিন আগে নীরব-ঘাতক রোগটার কথা জানলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম
তাদেরকে না জানানোর। ব্যবসার কথা বলে গাড়ি বিক্রি
করলাম। ওদের অজান্তে ব্যবসার সবকিছু বিক্রি
করে পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছি যা ওদের দুজনের একাউন্টে সমানভাবে জমা করেছি। এখন ওরা
ভালোভাবেই বেঁচে থাকতে পারবে। আর আমার একাউন্টে যা আছে তা দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত
ভালোই থাকবো।
--আমি আর শুনতে পারছি না...
লিজা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেলো। চয়ন ভাবছে, কালই কাউকে কিছু না বলে চলে
যেতে হবে এমন কোথাও যেখানে তাকে কেউ চেনে না। মৃত্যু তার,
অন্য কেউ কেন কষ্ট পাবে.....