আমাদের পরবর্তী সংখ্যায় লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের ফেসবুক পেজ এ ইনবক্স করুন অথবা ইমেইল করুন Ghuri2014@hotmail.com এই ঠিকানায়।

মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

আশ্রয় - রাজীব চোধুরী (১ম সংখ্যা)




এইযে শুনছেন? বাসায় কেউ আছেন?
কথাটা বলে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল নূপুর। নাবিল খানিকটা অস্বস্তিতে হাতের সিগারেট টা ফেলে দিল। ওর প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। টেনশনে পড়লে সে সিগারেট খায়। আজকে একটু বেশিই খাচ্ছে। কারন টেনশনের কারণ ঘটেছে। বিশাল ঘটনা। ওদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে মাঝ পথে। ড্রাইভারকে গাড়ি সহ দাঁড় করিয়ে রেখে ওরা এসেছে খাবারের খোঁজে। নারায়ণগঞ্জের এ জায়গাটাতে পুরো সুনসান।মানুষজন নেই। খুঁজতে খুঁজতে দুজনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা পুরনো কুটিরের সামনে।
-আরে এভাবে বললে কি কেউ এসে পড়বে? দেখেই মনে হচ্ছে কেউ নেই।
- আরে তাই বলে ঘরে ঢুকে পড়বে নাকি?- হিসহিসিয়ে বলল নূপুর
- তা বলছিনা। বলি সামনে গিয়ে দরজাটাতে টোকা দিলেও তো পারো
- চুপ থাকো। সাহস করে নিজে যাচ্ছোনা কেন?
- আরে মাত্র বিড়ি টেনেছি। মুখ থেকে গন্ধ বেরোচ্ছেনা?
- এটা খাওয়ার সময় মনে থাকেনা?
- ধুরো- তুমি দেখি শিবের গীত বেশিই গাইছ। যাও টোকা দাও।
- বলি মেয়েমানুষকে দিয়ে না করিয়ে কাজটা পুরুষের মতো করে করলে ও তো পারো।
- ওকে বাবা। যাচ্ছি- বলে নাবিল দুটো মাটির সিঁড়ি বেয়ে ঘরের দাওয়ায় ঢুকল সন্তর্পণে
 বাড়িটা একেবারেই পুরনো। মাটির বাড়ি। ছনের চাল। বেশ বড় এলাকাজুড়ে। অথচ আলো নেই। অবশ্য সেটা থাকার কথাও না। বাড়িটা সুনসান। কেউ যদি থাকে এই ভরসায় নাবিল দরজায় হাত রাখল।
- কে এ এ এ
কন্ঠটা শুনেই নাবিল প্রায় দ্বিগুণ গতিতে পেছন দিকে হেঁটে নূপুরের পাশে চলে গেল। যেন শব্দটা ওকে ধাক্কা মেরেছে। আসলে খনখনে কন্ঠটা ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।
- ইয়ে মানে আমরা একটু আশ্রয় চাইছিলাম।
- কি ই ই সে র র র জন্য য় য়
কন্ঠের মালকিনকে এখনো দেখা যায়নি। এর মাঝেই ল্যাম্পের একটা ক্ষীণ আলো দরজার ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে। সে আলো খানিকটা বেড়ে দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল। আর সে ফাঁক বেয়ে একটা বুড়ো মাথা বেড়িয়ে আসল যার গায়ে হাজারো দাগে ভর্তি। দুটো চোখ বসানো বলে মাথা বলে মনে হচ্ছে। শনপাপড়ির মত চুলগুলো লাচ্ছি-সেমাইয়ের মত জুড়ে দেয়া। আর ভরাট দুটো ভ্রুর খানিকটা নিচে দুটো চোখ। মহিলা একেবারেই বয়স্ক। কমকরে হলেও নব্বই বছর তো হবেই। ল্যাম্পের আলোয় বলিরেখা গুলো আরো কালচে বাকলের মতো মহিলার চেহারাকে ধোয়াশাচ্ছন্ন করে রেখেছে।
- ইয়ে মানে আমাদের গাড়িটা আটকে পড়েছে।
- আমার এখানেএএ থাকতে চাআআও? খাবে কিই-ইই?
- আন্টি খানিকটা চিড়ে মুড়ি বা পানি দিলেও হবে। রাত পেরোলেই আমরা চলে যাব।
- কি জন্য এসেছিলে এখানে?
- ঐ কিছুটা বেড়াতে- ইয়ে মানে তেমন কিছুনা। হানিমুন ট্যুর।
- ও।
 - সামনে কি আছে জানিনা । তাই আমাদের যদি এখানে একটু আশ্রয় দিতেন... খানিকটা বিনয় ফুটিয়ে তুলল নাবিল। এসকল তেল প্রদানের সময় নাবিলের সদ্য বেড়ে ওঠা পেটটা ফুলে ওঠে। আসলে অন্য সময় সে পেটের পেশিগুলো টানটান রাখে। নতুন বিয়ে করেছে বলে বৌ এর সামনে নিজেকে স্মার্ট সাঁজায়। যদিও তৈলমর্দন কালে সবকিছু ভুলে গ্যাছে সে।
- আচ্ছাআআ। এসো।
বাড়ির ভেতর অনেকগুলো কামড়া। নাবিল আর নূপুর এসে শুয়েছে একটাতে। এর পর আর বুড়ির দেখা নেই। পানি চেয়েছিল নূপুর। তারপর থেকে কোন হদিশ নেই।
বাড়িতে কেউ নেই বললে ভুল হবে। ল্যাম্পের টসটসে আলোয় নূপুর খানিক আগেই একটা কালো বেড়ালকে এদিক থেকে ওদিকে হেঁটে যেতে দেখেছে। খেয়াল করেনি সে। কিংবা পাত্তা দেয়নি। ঘরের ভেতর বেশ ঠান্ডা। এতটা ঠান্ডা যে খানিক পরেই দুজনেই কেঁপে উঠতে শুরু করেছে ঠান্ডায়।
 - আচ্ছা আমাদের কি পানি টানি কিছু দেবে মহিলা? – নাবিলের কন্ঠে ঝাঁজ।
- আচ্ছা বসতে দিলে তুমি শুতে চাও কেন? মহিলা বুড়ো মানুষ। নিতান্তই আমার বাড়ি না। নইলে আমি নিজেই পানি খেয়ে নিতাম।
- আরে আরে ওটা কি?
- কি ?
- আমি দুটো ভিন্ন ভিন্ন রঙের বেড়াল হেঁটে যেতে দেখেছি।
- আরে ধুর। অন্ধকারে আবার বেড়াল!
- আসলেই তাই।
- কি সব বলছ। মাথা গেছে নাকি?
- সত্যি।
- চলো দেখে আসি ঘটনা কি
- চলো
দুজনে ধীরে ধীরে ল্যাম্প নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘরের বাইরে। একটা ছোট্ট হলঘরের মত ঘরে এসে থমকে গেল নাবিল। পেছনে নূপুরের চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে। কারণ আর কিছুই না। ত্রিশ থেকে চল্লিশটা বেড়াল বসে আছে ওখানে। মহিলাকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। বেড়ালগুলো অদ্ভুতভাবে বসে আছে। বসে থাকার ভঙ্গিটা বেশ অসহনীয়। কারণ প্রায় গোল করে বসেছে সবাই। ঘরের চারদিকে। যেন ঘরে কোন সভা চলছে। সে সভার ফলাফল জানার জন্য বসেছে সবাই।
- ইয়ে নূপুর আমার মনে হয় আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে।
- হ্যাঁ। আমাদের সাহায্যের দরকার নেই।
- চলো।
পেছনে পা বাড়িয়ে থমকে গেল নাবিল। কারণ আর কিছুই না। বাড়িটার সদর দরজা যেদিকে সেদিক থেকে বাইরের রাতের উঠোন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আসলে দেখা যাচ্ছে চোখ গুলো। রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে চোখ গুলো। অন্তত শখানেক চোখ। চোখগুলো ছোট বলেই চিনতে পেরেছে নাবিল। ওগুলো বেড়ালের চোখ। অপেক্ষা করছে যেন।
কেন অপেক্ষা করছে?
কি হবে অপেক্ষা করে?
নূপুরের মনে হাজারো প্রশ্নের বান উঠেছে। বুড়ি কে? কেন এত বেড়াল? কি হবে?
- চলো পালাই। নূপুরের কন্ঠে ভয়।
- চলো।
কিন্তু নাবিলের কথাটা শেষ হবার আগেই শিসের শব্দটা শুনতে পেল নাবিল। একটা তীক্ষ্ম শব্দ। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে এরপরেই উঠে দাঁড়ালো বেড়ালগুলো। এতক্ষণ বসেছিল। এখন যেন ওদের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ওদের কাজ শুরু হল।
এবং কাউকে বলে দিতে হলোনা। সবাই প্রায় একসাথেই ওদের দিকে এগোচ্ছেবাড়ির ভেতরের বেড়ালগুলো পেছন থেকে ঘিরে ধরছে ওদের। ধীরে ধীরে বৃত্ত ছোট হচ্ছে। বৃত্তের মাঝে ওরা দুজন। একান্ত অসহায়।
............

ইয়ে বাড়িতে কেউ আছেন?
শব্দটা করে শফিক বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো সামনের দিকে। সেখানে দুটো মুখ দেখা যাচ্ছে। বেশ বুড়ো দুটো মুখ। মাটির বাড়িটির ছোট্ট একটা জানালা খানিক আগে খুলেছে। সেখান থেকে ল্যাম্পের টিমটিমে আলোয় দেখা যাচ্ছে মাথা-দুটো। একেবারেই বুড়োটে দুটো মাথার মাঝে একটা মাথা পুরুষের। আরেকজন নারীর মাথা ও এর মাঝে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুখের বলিরেখা গুলো বেশ ধারালো ভাবে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে ওদের। দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্বামী স্ত্রী। দুজন মানুষ এই সুনসান এলাকায় কিভাবে বেঁচে আছে ভাবতে ভাবতে শফিক চিৎকার করে বলল-
- ইয়ে আমার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে খানিক দূরে। আমি কি আজকের রাতের জন্য একটু থাকতে পারি?