দিনটা ছিল রবিবার । মিলির সাথে ঐ দিনই শেষ কথা হল । মিলি তার মনের কথা গুলো আমাকে খুলে বলল । তারপরই ফোনের কনভারসেশনটা রেখে দিল । আমাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দিল না । তারপর অনেক ফোন দিয়েছি কিন্তু কোন জবাব বা প্রতিউত্তর পাইনি । আমিও এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করি । কিন্তু, নাহ! পারলাম না । মিলির প্রচন্ড ভালবাসা আমাকে ছাড়ল না । আমি চিন্তা করতে লাগলাম, কেন? মিলি বা তার বাবা আমাদের দেশকে, ভাষাকে এত অশ্রদ্ধা করে, অসম্মান করে । ধীরে ধীরে এই কথা জানার আগ্রহটা এক পর্যায়ে আমাকে বিষিয়ে তোলে । আমি আমার দেশের অনেকের কাছে মিলির দেশ সম্পর্কে জানতে চাই? কিন্তু, কেউই আমাকে আমার সঠিক উত্তরটা দিতে পারে না । মনে হচ্ছে সবাই আমার কাছে কী যেন লুকাচ্ছে । অবশেষে শরনাপন্ন হলাম বইয়ের উপর । অনেক কষ্টে দুটি বই জোগাড় করলাম । একটি হল "সুফিয়া কামালের লেখা একাত্তরের ডায়েরী " এবং আরেকটি হল "এ.আর. মল্লিকের লেখা বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম" । নতুন উদ্যম নিয়ে পূনরায় শুরু করলাম । পড়লাম! খুব ভাল করেই পড়লাম । একবার নয়, কয়েকবার । অবশেষে, চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না । নিজের অজান্তে চোখের কোনা বেয়ে রুপালী অশ্রু গড়িয়ে পড়লো । আর কিছু না হোক এটুকু বুঝলাম যে, নিজের দেশকে কতটুকু ভালবাসলে নিজেকে, সন্তানকে, পরিবারকে তুচ্ছ করা যায় । নিজের বুকের রক্ত ঢেলে সাদা মাটিকে লালে পরিনিত করা যায় । আরও বুঝলাম আমাদের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা । ক্ষমতা যে মানুষকে তার মনুষ্যত্ত্ব হারিয়ে ফেলতে সাহায্য করে তাও বুঝলাম ।
অবশেষে চলে এলাম বাংলার মাটিতে । সবুজ ঘাসের মাটিতে পা রাখতেই মনটা প্রফুল্লে ভরে উঠল । এসে অবশ্য বসে থাকেনি । মিলি ও তার পরিবারকে অনেক খুঁজেছি ।
আজ পাঁচটা বছর হয়ে গেল । আজ ও মিলিকে খুঁজে পেলাম না । ওরা কোথায় আছে, কেমন আছে তা ও জানিনা । তবু ও ওদেরকে আমি পাগলের মত খুঁজে বেড়াই । আর এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি ।
আজ স্কুলে তাড়াতাড়ি যেতে হবে । আগামী স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটা মিটিং আছে । রিক্সায় করে স্কুলের উদ্দেশ্য যাত্রা করি । স্কুলে পৌছে রিক্সাওয়ালাকে তার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে সোজা চলে গেলাম মিটিং রুমে । মিটিং শেষ হতে প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে গেল । মিটিংয়ে এক একজন শিক্ষকের উপর এক একটি দায়িত্ব পড়ল । আর আমি যেহেতু, বাংলা বিভাগের শিক্ষক সেহেতু, আমার উপর দায়িত্ব পড়ল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে অবহিত করা । দায়িত্বটা পেয়ে আমিও অনেক খুশি হলাম । কারণ আমিও মনে মনে চেয়েছিলাম এরকম কিছু ।
সারা স্কুলে সাজ সাজ রব পড়ে গেল । যে যার দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করতে লাগল । স্কুল পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে শুরু করে সাজানো সহ সকল কাজই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ হতে লাগল ।
আজ বাসায় এসে হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল । নতুন একটা ছাত্রীর সাথে পরিচয় হল । ওকে দেখেই হঠাৎ মিলির কথা মনে পড়ল । মেয়েটা পড়ে তৃতীয় শ্রেণীতে । নতুন ভর্তি হয়েছে । আর আশ্চার্যের বিষয়টি হল ঐ মেয়েটির নাম ও মিলি । ওর গড়নটা ও অবয়ব মিলির মত ।
যাহোক, এসে গেল সেই বহুপ্রতীক্ষিত দিনটি ১৬ই ডিসেম্বর । স্কুলে এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে দোয়া-মাহফিল অনুষ্ঠান । পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে কবিতা আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক গান, রচনা, ছড়া ইত্যাদি প্রতিযোগিতার । আজ সবাই খুব তাড়াতাড়ি স্কুলে আসল । যথাসময়ে, কুরআন শরীফ তেলাওয়াত এর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হল । প্রতিযোগীরা সবাই প্রস্তুত । একে একে প্রত্যেকে এসে প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করল । মিলি নামের ঐ মেয়েটিও প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করল । ও অংশগ্রহণ করলো কবিতা আবৃত্তিতে । ওর কবিতাটির কয়েকটি লাইন হল______________________
সুন্দর এই বাংলাদেশে, সুন্দর এই ধরায়,
ধ্বংস হল বাংলাদেশ পাকিস্তানী হানাদারের বুটের পারায় ।
তবু বাংলার দামাল ছেলেরা থেমে থাকেনি,
আজ হল ১৬ই ডিসেম্বর মোরা দেশ স্বাধীন করেছি ।
অদ্ভুত লাগল কবিতাটি । যাহোক, পুরস্কার বিতরণী শুরু হয়ে গেল একে একে সবাই এসে পুরস্কার নিয়ে যাচ্ছে । মিলি ও পুরস্কার নিতে এসেছে । হঠাৎ করেই অজানা আনন্দে বুকের ভেতরটা উদ্ধেলিত হয়ে উঠল । তারপর_________
অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগে । আমি আর মিলি কথা বলছিলাম । বললাম_____________
বাসায় তোমার আর কে কে আছে মিলি?
আমি আর নানা ভাই । মিলি বলল ।
তোমার বাবা মা?
বাবা কোথায় জানিনা । বাবার কথা জিজ্ঞসা করলে কেউ কোন উত্তর দেয়না । আর মা! মা আমার জন্মের সময় আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ।
অদ্ভুত দুনিয়া । এতটুকু মেয়ে কিন্তু, দেখলে মনে হয় না, যে ওর ঐ হাস্যেজ্জ্বল মুখের আড়ালে এত দুঃখ জমে আছে । আসলে ব্যাপারটা ভাবাই দুষ্কর । যাহোক, এবার বাসায় যাওয়ার পালা । আমি বললাম যে,
তুমি বাসায় যাবে কীভাবে? তোমার বন্ধুরা তো তোমাকে রেখে চলে গেছে ।
মিলি বলল একা একা যেতে হবে ।
আচ্ছা একা একা যাওয়া লাগবে না । চলো আমি তোমাকে তোমার বাসায় পৌছে দিই ।
এরপর স্কুল থেকে বের হয়ে মিলিদের বাসার উদ্দেশ্য, মিলিকে নিয়ে রওনা হই । অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলিদের বাসার সামনে চলে এলাম ।
স্যার আসুন আমাদের বাসায় থেকে এক কাপ চা খেয়ে যান ।
আমি ইতিমধ্যে ঐ মেয়েটির প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছি । যার কারণে আমিও আর না করতে পারলাম না । আমি ওর সাথে বাসার ভিতরে আসলাম । আমাকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল ।
ড্রয়িং রুমের চারপাশটা দেখতে গিয়ে হঠাৎ একটা জায়গায় গিয়ে আমার চোখ আটকে গেল । কিছুতেই যেন চোখ দুটি দেয়ালে আটকানো ছবিটার দিক থেকে সরাতে পারছিনা । এর মধ্যে মিলির নানা ঘরে ঢুকলেন । অপরিচিত লোক দেখে সাধারণত লোকে যা বলে তিনি ও তার ব্যতিক্রম করলেন না । বললেন ___________
কে আপনি?
ততক্ষণে আমার চোখের কোণায় রুপালী বিন্দু জমা হয়ে গেল । আমি বললাম __________
আমি! আমি আবু জাহিদ ।
নামটা শোনার সাথে সাথে বিদ্যুৎতের মত চমকে উঠলেন এবার রহমান সাহেব । কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা হাতে নিয়ে বললেন __________
তুমি কি সেই আবু জাহিদ?
হ্যাঁ! আমি সেই আবু জাহিদ যে, আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম ।
আর আত্মসম্বরণ করতে পারলেন না রহমান সাহেব । দুহাতে আমাকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেললেন ।
আমাদের দুজনের মঞ্চ নাটকের এতক্ষণ মিলি দেখছিল । তার বুঝতে মনে হয় বেশ বেগ পেতে হয়েছে কিছুক্ষণ পর তার মুখ থেকে শুধু এতটুকুই উচ্চারণ হল________________ বাবা!