আমাদের পরবর্তী সংখ্যায় লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের ফেসবুক পেজ এ ইনবক্স করুন অথবা ইমেইল করুন Ghuri2014@hotmail.com এই ঠিকানায়।

বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৫

সূর্য তুমি স্বাক্ষী - আসাদ সুমন (৩য় সংখ্যা)

                                           
মন খারাপ করে ছোট্ট চায়ের দোকানটাতে বসে আছেন শামসু মিয়াভালো নাম শামসুর রহমানদোকান না বলে খুপড়িঘর বলাই ভালোকালো দাগ পড়া গোটা পাঁচেক কাপ আর দুমড়ানো দুইটা কেটলি নিয়ে তার দোকানদারিকয়েকটা টোস্ট বিস্কুট ঝুলছে দোকানের সামনের অংশেকয়েকটা কমদামী সিগারেটের প্যাকেট আর বিড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার সামনেবাংলাদেশের গ্রাম গুলোর চেহারা বদলে যেতে শুরু করেছে আরো কয়েক বছর আগে থেকেইগ্রামে এখন বিদ্যুৎ,ডিস লাইন সহ নাগরিক প্রায় সকল সুবিধাই পৌঁছে গেছেতবে কেন জানি মুকসুদপুর গ্রামটা যেন থমকে আছে শত বছর আগের জায়গাতেইগ্রামের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি এখনো কাঁচাশামসু মিয়ার দোকানটা গ্রামের দৈন্যতা আরো বাড়িয়েছেমাটির তৈরি দোকানটির চালেও টিন নেইছন দিয়ে কোনমতে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছেযেকোনো মুহুর্তে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ার জন্য দোকানটা যেন একেবারে তৈরি হয়ে আছেএখন শুধু প্রকৃতির দয়ার অপেক্ষা
শামসু মিয়ার মন আরো খারাপ হচ্ছেবিরক্তি প্রকাশ করতেও পারছেন না যে দুজন ক্রেতা দোকানের সামনের ভাঙ্গা বেঞ্চটায় বসে আছেন তাদের তিনি একদম সহ্য করতে পারেন নাকিন্তু সামনে কিছু বলার সাহস তার নেই বলেই বিরক্তি বেড়েই চলেছে তিনি মনে মনে বললেন 'কুত্তার বাচ্চাদুইটা যায়না ক্যান?'


'তাইলে অবশেষে মন্ত্রী হয়েই ছাড়লেন সোবহান সাবতার খেইলডা দেখলা রজব মিয়া' কথাটা বলেই পিচ করে পানের পিক ফেললেন বশির মিয়া
বশির মিয়া আর রজব আলির হাবভাবে খুব শীগগির দোকান ছেড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনাচা খাওয়ার পরে এবার আরাম করে পান চিবুচ্ছেন দুজনেইদুজনের কথাবার্তা বিষের মতলাগছে শামসু মিয়ার কাছেচায়ের কেটলি নামিয়ে আগুনের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করে অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করছেন তিনিকিন্তু তাতে লাভ হচ্ছেনা খুব একটানা শুনতে চাওয়া কথাগুলো যেন আরো স্পষ্ট হয়ে বিঁধছে বুকের ভেতর

'তা আর বলতেচক্ষের সামনেই তো খেইলডা দেখলামনমিনেশনই দেয়না,আর এহন মন্ত্রী সোবহান সাবটেকা থাকলে সব হয়দেশে ঢুকতে না পাইরা কতগুলা বছর পালাইয়া রইলেন পাকিস্তানেশেখ সাব মরার পরই সবকিছু রাতারাতি বদলাইয়া গেলো এহন কার সাহস আছে তারে সোবহান রাজাকার কয় মন্ত্রী সাব কওয়া লাগব মন্ত্রী সাবনাহয় কল্লা থাকবনা ঘাড়ের উপর"
'একদম ঠিক কথা' রজব আলির কথায় সায় দেয় বশির মিয়া 'অতো আগের কথা মনে রাইখ্যা লাভ নাইযার পা ধইরা থাকলে আমাগো পেটে ভাত যাইব তার পা চাটতেও আমাগো আপত্তি নাই' যোগ করে বশির মিয়া
'হক কথাএকদম ঠিক কথা' সাথে সাথেই সায় দেয় রজব আলিআরো কিছুক্ষণ বকবক করে বিদায় হয় দুইজন শামসু মিয়া যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেনশব্দ করেই বলে উঠেন 'শালা দুইড্যা আসলেই কুত্তার বাচ্চা'

শামসু মিয়ার একটা পা নেইহাঁটুর নিচে থেকে কাটা পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়যুদ্ধ করার সময় লাভ লোকসান বিচার করেন নাইশেখ মুজিব নামক লোকটার ভাষণ শুনে আর স্থির থাকতে পারেননিবাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধেসদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর কাছে ফিরে এসেছিলেন একটা পা হারিয়েতাতে বেশি দুঃখ ছিলনা যতটা দুঃখ পেয়েছিলেন দেশটা স্বাধীন হওয়ার বছর পাঁচেকের মাথায়ই শেখ সাহেব খুন হয়ে যাওয়ায় তারপর শুধু তার অবাক হওয়ার পালাশেখ সাহেবের ভয়ে যেসব রাজাকাররা দেশে ঢোকার সাহস পায়নি তারা একে একে ফিরে এসে জামাই আদর পেতে লাগলোমুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টা গর্বের থেকে ধীরে ধীরে আতংকের রূপ নিলোএখন আর বুক ফুলিয়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেন নাঅভাব অনটনের সংসারে কোনরকমে বেঁচে আছেন তিনিবড়ছেলেটার চিকিত্‍সা করাতে জমিজমা বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক আগেইকিছুদিন সদরে গিয়ে ভিক্ষেও করেছেনতবু বাঁচাতে পারেননি বুকেরমানিককেছোট ছেলেটা নিরুদ্দেশ হয়েছে বছর আটেক হলোস্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে একমাত্র মেয়েটা গলায় দড়ি দিয়েছে গেল বছরতিনি বেঁচে আছেন এত কষ্ট নিয়েওমরতে পারেননিমরি মরি করেও মরা হয়নিযমে মানুষে টানাটানি হয়ে গেছে কয়েকবারতবুও মরতে মরতে বেঁচে গেছেনশরীর চলেনাদোকানের সামান্য আয়ে আধপেটা খেয়ে কোনমতে চলে যায় বুড়োবুড়ির সংসারআগে আড়ালে ডাকলেও এখন অনেকেই সামনাসামনি ডাকে শামসু পাগলা বলেতিনি রাগ করেন নাঅভিশপ্ত জীবনে রাগ করতে নেই তিনি বুঝে গেছেননিজের চোখে দেখা পাক বাহিনীকে পথ দেখিয়ে দেওয়া সোবহান রাজাকার এখন মন্ত্রী বড় আজিব এই দেশশুক্রবার দিনসিগারেট আর বিড়ির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কালীবাড়ির মাঠে আসতেই শামসু মিয়ার মনে হলো আজ বাড়ি থেকে বের হওয়া ঠিক হয় নাইসাদেকের মা না করেছিল বারবারতিনদিন ধরে তার জ্বরদোকান খুলতে পারেন নাইআজ না খুললে উপোষ করতে হবেতাই জ্বর শরীরে কাঁপতে কাঁপতেই বের হয়েছেন তিনিএখন বুঝতে পারছেন শরীর তার ধারণার থেকেও খারাপমাথা ঝিমঝিম করছেদুপুর বেলার আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরছেদরদর করে ঘামছেন শামসুমিয়াআশেপাশে কোন বড় গাছও নেই যে একটু বসে বিশ্রাম নেবেনলাঠিতে ভর দিয়ে একপা টেনে টেনে অতিকষ্টে হাঁটছেন তিনিকেবলই মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাবেনতিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন হাত পা কোনটাই তার নির্দেশ মানছেনাতিনি হুড়মুড় করে ভাঙ্গা গাছের মত মুখ থুবড়ে মাঠের মধ্যে পড়ে গেলেনচোখে প্রায় কিছুই দেখতে পারছেন নাচোখ বন্ধ করেই পড়ে আছেন অনেকক্ষণ মুখ দিয়ে একটা গোঙানির শব্দ বেরুচ্ছে হঠাত্‍ প্রচন্ড হইচই শুনতে পেলেনতাকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে অনেকগুলো মানুষদুইজন,পাঁচজন, দশজন,অনেকজন মানুষের অস্পষ্ট কথাবার্তা কানে আসতে লাগলো তারশামসু মিয়ার মনে পড়ে গেলো আজ সোবহান রাজাকারের মন্ত্রী হওযার জন্য সংবর্ধনা দেওয়া হবেসবাই ছুটে যাচ্ছে সেদিকেতার দিকে তাকানোর সময় নেই কারওতিনি অতি কষ্টে চোখ খুললেন মাথার উপর গনগনে সূর্যটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন নাচোখ বেশিক্ষণ খোলা রাখা গেলনারাজ্যের ঘুম এসে ভর করতে লাগল তার চোখে এইবার চিরদিনের মত চোখ বন্ধ করলেন শামসু মিয়া মুক্তিযোদ্ধা শামসু মিয়া।