মন খারাপ করে ছোট্ট চায়ের দোকানটাতে বসে আছেন শামসু মিয়া। ভালো
নাম শামসুর রহমান। দোকান না বলে খুপড়িঘর বলাই ভালো। কালো দাগ পড়া গোটা পাঁচেক কাপ আর দুমড়ানো
দুইটা কেটলি নিয়ে তার দোকানদারি। কয়েকটা টোস্ট বিস্কুট ঝুলছে দোকানের সামনের
অংশে। কয়েকটা কমদামী সিগারেটের প্যাকেট আর বিড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার সামনে। বাংলাদেশের গ্রাম গুলোর চেহারা বদলে যেতে শুরু করেছে আরো কয়েক বছর আগে থেকেই। গ্রামে এখন বিদ্যুৎ,ডিস লাইন সহ নাগরিক প্রায় সকল সুবিধাই পৌঁছে
গেছে। তবে কেন জানি মুকসুদপুর গ্রামটা যেন থমকে আছে শত বছর আগের জায়গাতেই। গ্রামের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি এখনো কাঁচা। শামসু মিয়ার দোকানটা গ্রামের দৈন্যতা আরো
বাড়িয়েছে। মাটির তৈরি দোকানটির চালেও টিন নেই। ছন দিয়ে কোনমতে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ার জন্য দোকানটা যেন একেবারে তৈরি হয়ে
আছে। এখন শুধু প্রকৃতির দয়ার অপেক্ষা।
শামসু মিয়ার মন আরো খারাপ হচ্ছে। বিরক্তি
প্রকাশ করতেও পারছেন না। যে
দুজন ক্রেতা দোকানের সামনের ভাঙ্গা বেঞ্চটায় বসে আছেন তাদের তিনি একদম সহ্য করতে
পারেন না। কিন্তু সামনে কিছু বলার সাহস তার নেই বলেই বিরক্তি বেড়েই চলেছে। তিনি মনে মনে বললেন 'কুত্তার বাচ্চাদুইটা যায়না ক্যান?'
'তাইলে অবশেষে মন্ত্রী হয়েই ছাড়লেন সোবহান সাব। তার খেইলডা দেখলা রজব মিয়া। '
কথাটা বলেই পিচ করে পানের পিক ফেললেন বশির
মিয়া।
বশির মিয়া আর রজব আলির হাবভাবে খুব শীগগির
দোকান ছেড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। চা খাওয়ার পরে এবার আরাম করে পান চিবুচ্ছেন
দুজনেই। দুজনের কথাবার্তা বিষের মতলাগছে শামসু মিয়ার কাছে। চায়ের
কেটলি নামিয়ে আগুনের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করে অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছেনা খুব একটা। না শুনতে চাওয়া কথাগুলো যেন আরো স্পষ্ট হয়ে
বিঁধছে বুকের ভেতর।
'তা আর বলতে। চক্ষের সামনেই তো খেইলডা দেখলাম। নমিনেশনই দেয়না,আর এহন মন্ত্রী সোবহান সাব। টেকা থাকলে সব হয়। দেশে ঢুকতে না পাইরা কতগুলা বছর পালাইয়া
রইলেন পাকিস্তানে। শেখ সাব মরার পরই সবকিছু রাতারাতি বদলাইয়া গেলো। এহন কার সাহস আছে তারে সোবহান রাজাকার কয়। মন্ত্রী সাব কওয়া লাগব। মন্ত্রী সাব। নাহয়
কল্লা থাকবনা ঘাড়ের উপর। "
'একদম ঠিক কথা। '
রজব আলির কথায় সায় দেয় বশির মিয়া। 'অতো
আগের কথা মনে রাইখ্যা লাভ নাই। যার পা ধইরা থাকলে আমাগো পেটে ভাত যাইব তার
পা চাটতেও আমাগো আপত্তি নাই' যোগ করে বশির মিয়া।
'হক কথা। একদম
ঠিক কথা। ' সাথে সাথেই সায় দেয় রজব আলি। আরো
কিছুক্ষণ বকবক করে বিদায় হয় দুইজন। শামসু মিয়া যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। শব্দ করেই বলে উঠেন 'শালা দুইড্যা আসলেই কুত্তার বাচ্চা। '
শামসু মিয়ার একটা পা নেই। হাঁটুর নিচে থেকে কাটা পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের
সময়। যুদ্ধ করার সময় লাভ লোকসান বিচার করেন নাই। শেখ মুজিব নামক লোকটার ভাষণ
শুনে আর স্থির থাকতে পারেননি। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধে। সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর কাছে
ফিরে এসেছিলেন একটা পা হারিয়ে। তাতে বেশি দুঃখ ছিলনা যতটা দুঃখ পেয়েছিলেন দেশটা স্বাধীন হওয়ার বছর পাঁচেকের
মাথায়ই শেখ সাহেব খুন হয়ে যাওয়ায়। তারপর শুধু তার অবাক হওয়ার পালা। শেখ সাহেবের ভয়ে যেসব রাজাকাররা
দেশে ঢোকার সাহস পায়নি তারা একে একে ফিরে এসে জামাই আদর পেতে লাগলো। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টা গর্বের
থেকে ধীরে ধীরে আতংকের রূপ নিলো। এখন আর বুক ফুলিয়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেন না। অভাব অনটনের সংসারে কোনরকমে
বেঁচে আছেন তিনি। বড়ছেলেটার চিকিত্সা করাতে জমিজমা বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক আগেই। কিছুদিন সদরে গিয়ে ভিক্ষেও
করেছেন। তবু বাঁচাতে পারেননি বুকেরমানিককে। ছোট ছেলেটা নিরুদ্দেশ হয়েছে বছর আটেক হলো। স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে একমাত্র মেয়েটা গলায় দড়ি দিয়েছে গেল বছর। তিনি বেঁচে আছেন এত কষ্ট নিয়েও। মরতে পারেননি। মরি মরি করেও মরা হয়নি। যমে মানুষে টানাটানি হয়ে
গেছে কয়েকবার। তবুও মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। শরীর চলেনা। দোকানের সামান্য আয়ে আধপেটা খেয়ে কোনমতে চলে যায়
বুড়োবুড়ির সংসার। আগে আড়ালে ডাকলেও এখন অনেকেই সামনাসামনি ডাকে শামসু
পাগলা বলে। তিনি রাগ করেন না। অভিশপ্ত জীবনে রাগ করতে নেই তিনি বুঝে গেছেন। নিজের চোখে দেখা পাক বাহিনীকে পথ দেখিয়ে দেওয়া সোবহান রাজাকার এখন মন্ত্রী। বড় আজিব এই দেশ। শুক্রবার দিন। সিগারেট আর বিড়ির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কালীবাড়ির মাঠে
আসতেই শামসু মিয়ার মনে হলো আজ বাড়ি থেকে বের হওয়া ঠিক হয় নাই। সাদেকের মা না করেছিল বারবার। তিনদিন ধরে তার জ্বর। দোকান খুলতে পারেন নাই। আজ না খুললে উপোষ করতে
হবে। তাই জ্বর শরীরে কাঁপতে কাঁপতেই বের হয়েছেন তিনি। এখন বুঝতে পারছেন শরীর তার ধারণার থেকেও খারাপ। মাথা ঝিমঝিম করছে। দুপুর বেলার আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরছে। দরদর করে ঘামছেন শামসুমিয়া। আশেপাশে কোন বড় গাছও নেই
যে একটু বসে বিশ্রাম নেবেন। লাঠিতে ভর দিয়ে একপা টেনে
টেনে অতিকষ্টে হাঁটছেন তিনি। কেবলই মনে হচ্ছে এই বুঝি
পড়ে যাবেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন হাত পা কোনটাই তার
নির্দেশ মানছেনা। তিনি হুড়মুড় করে ভাঙ্গা গাছের মত মুখ থুবড়ে মাঠের
মধ্যে পড়ে গেলেন। চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পারছেন না। চোখ বন্ধ করেই পড়ে আছেন অনেকক্ষণ। মুখ দিয়ে একটা গোঙানির শব্দ বেরুচ্ছে। হঠাত্ প্রচন্ড হইচই শুনতে পেলেন। তাকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে অনেকগুলো মানুষ। দুইজন,পাঁচজন,
দশজন,অনেকজন। মানুষের অস্পষ্ট কথাবার্তা কানে আসতে
লাগলো তার। শামসু মিয়ার মনে পড়ে গেলো আজ সোবহান রাজাকারের
মন্ত্রী হওযার জন্য সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সবাই ছুটে যাচ্ছে সেদিকে। তার দিকে তাকানোর সময় নেই কারও। তিনি অতি কষ্টে চোখ
খুললেন। মাথার উপর
গনগনে সূর্যটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। চোখ বেশিক্ষণ খোলা রাখা গেলনা। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করতে
লাগল তার চোখে। এইবার
চিরদিনের মত চোখ বন্ধ করলেন শামসু মিয়া। মুক্তিযোদ্ধা শামসু মিয়া।