আমাদের পরবর্তী সংখ্যায় লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের ফেসবুক পেজ এ ইনবক্স করুন অথবা ইমেইল করুন Ghuri2014@hotmail.com এই ঠিকানায়।

বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৫

সাদা সাদা মেঘগুলি - নাসিম বিজয় (৩য় সংখ্যা)


রমনার এক বেঞ্চিতে বসে অনিরুদ্ধ সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেনসরাসরি নয়,গাছের পাতার ফাকা দিয়েএটা তার অভ্যাসযখন তিনি একা থাকেন,প্রায়ই তাকে এ কাজটি করতে দেখা যায়আরও দেখা যায় পানির দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকতেতার সামনেই রমনার বিশাল পুকুরপানিতে হোক আর আকাশেই হোক,মেঘ দুজায়গাতেই দেখা যায়আকাশে মেঘ ওড়ে,আর পানিতে ভাসে-এরকমটা ভাবতে তার ভাল লাগে
হঠাৎ তার বেঞ্চির সামনের রাস্তাটিতে বুঝি কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল
অনিরুদ্ধ সাহেবের চোখ সেদিকে যেতেই তিনি দেখছেন এক যুবক একটি মেয়ের হাত ধরে মেয়েটিকে দাড়াতে সাহায্য করছেমেয়েটি দাড়িয়ে থ্যাংকস বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই হাটতে শুরু করলোছেলেটি বিড়বিড় করে কি যেন বললো,তারপর সেও তার গন্তব্যে রওনা দিল
মনে পড়ে,এক বৃহস্পতিবারে রিনা এভাবে এই একই পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল,এই বেঞ্চিটিরই সামনে
অনিরুদ্ধ সাহেব তখন বাইশ বছরের যুবকতিনি মেয়েটিকে পড়ে যেতে দেখে হাটা থামালেনতারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন তিনিমানুষ এতো সুন্দর হতে পারে!তার তখন মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা রূপবতী নারীদের একজন তার সামনে রমনার এক রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলতিনি মেয়েটির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেননে যেন চাঁদ দেখছে,পূর্ণিমার চাঁদহঠাৎ মেয়েটি বললো,

-এই যে,হাধারামের মতো কি দেখছেন?দেখছেন একটা মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে,কই উঠতে হেলপ্ করবেন,আর হা করে তাকিয়ে আছেন


-না মানে. . .

-আরে মানে টানে পড়ে
আগে ক্র্যাচটা একটু দিনদেখছেন তো পায়ে সমস্যা,উঠতে পারছিনা

এতক্ষণ তার চোখই যায়নি মেয়েটির পায়ের দিকে
মেয়েটি হাটতে পারেনা স্বাভাবিকভাবেক্র্যাচে­র উপর ভর করে হাটতে হয় মেয়েটিরবিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে না উঠতেই মেয়েটি আবারো বলে উঠলো,

-কি হলো?
দিচ্ছেন না যে?

-ও হ্যাঁ হ্যাঁ
দুঃখিতআমি আসলে আপনার পা খেয়াল করিনি

বলতে বলতে ঢালু থেকে তুলে ক্র্যাচটা দিলেন তিনি
মেয়েটির হাত ধরে সাহায্য করলেন মেয়েটিকেমেয়েটি বললো,

-থ্যাংকস

-ম্যানশন নট
কিন্তু আপনার পা এরকম কিভাবে হলো?

-ছোটখাটো একটা এক্সিডেন্ট বলা যেতে পারে
আরেকদিন দেখা হলে বলবোআমি একটু ব্যস্ত

-আচ্ছা

-যাই তাহলে...বাই

জবাবের অপেক্ষা না করেই মেয়েটি এক-পা এক-পা করে এগুতে লাগলো
হঠাৎ তিনি পেছন থেকে ডাকলেন মেয়েটিকে,

-এই যে. . .

মেয়েটি পেছনে তাকালো
মেয়েটির চোখের দিকে তাকানো কষ্টকরএ যেন মধুর কষ্টঅতিমাত্রায় সুন্দর কোনো কিছুর দিকে একনজরে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়নামেয়েটি যেন চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো,কি জন্যে ডেকেছেন? তিনি তখন বললেন,

-আপনার ঘড়িটা...পড়ে গিয়েছিলো হয়তো তখন


-মেয়েটি নিজ হাতের দিকে তাকালো
তারপর হঠাৎ জোরে বলে উঠলো,

-ও থ্যাংকস গড
থ্যাংক ইউ সো মাচদিন এটা আমায়এটা আমার সবচাইতে প্রিয় জিনিসবাবার দেয়া শেষ উপহার

-বাবার দেয়া শেষ উপহার মানে?তিনি কি আর বেচে নেই?

মেয়েটি মাথা নাড়লো
তার বাবা বেচে নেইমেয়েটি বললো,

-থ্যাংকস এগেইন এন্ড গুড বাই


-বাই. . .

মেয়েটি আবার হাটা শুরু করলো সেই একই গতিতে
যতক্ষণ মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছিলো
অনিরুদ্ধ সাহেব মেয়েটির এক পা করে সামনে আগানোর দৃশ্য দেখছিলেনহঠাৎ তার মনে হলো,মেয়েটির নামটাই তো জানা হলনাএকই সাথে ভাবতে থাকেন,মেয়েটির নাম জানতে কেন ইচ্ছে করছে তার?সে কি মেয়েটির প্রেমে পড়েছে?সিনেমা আর গল্প-উপন্যাসের মতো প্রথম দেখায় প্রেম?কে জানে এসব?অনিরুদ্ধ সাহেব এসব ভাবতে ভাবতে মুচকি হাসলেনআবার হাটতে শরু করলেন পাবলিক লাইব্রেরীর দিকে রমনার পথ ধরে

সেদিন পাবলিক লাইব্রেরী গিয়ে কোন পড়া হয়নি তার
বই রেখে আবার ঐ মেয়েটির হোঁচট খাওয়া জায়গার সামনের বেঞ্চিটিতে এসে বসলেনতারপর হারিয়ে গেলেন গভীর ভাবনায়

ভাবনার ঘোর কাটতেই অবাক হলেন তিনি
কখন সন্ধ্যা হয়ে গেল তিনি বুঝতেই পারেননিহঠাৎ চারদিক অন্ধকার দেখা ব্যাপারটা অসংজ্ঞায়িতনিজেকে বোকা বোকা মনে হয়
সে হেটেই রাতে বাসায় ফিরলো,অনেক কথা ভাবতে ভাবতে
তার কি উচিত ছিলনা মেয়েটিকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে আসা?

সেই রাতটাও বুঝি যেতে চায়না
অঘুমে কাটলো ফজরের আগ পর্যন্তফজরের ঠিক পরপরই গভীর ঘুমসেই ঘুম ভাঙলো দুপুর বারোটায়মা অনেক ডেকে উঠালেনঅনি,এই অনিউঠ এক্ষুনিবারোটা বাজে ঘড়িতেউঠ....
দেরিতে ঘুম থেকে উঠায় মা বকবক করেই যাচ্ছেন
ওসব কিছুই কানে ঢুকছেনা তারসে ঘুম থেকে উঠতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লোদুইটার মধ্যে তাকে রমনায় পৌছাতে হবে
ঘড়িতে একটা সাইত্রিশ
রমনার ঐ বেঞ্চিটায় বসে আছে অনিবাইশ বছরের সুদর্শন যুবকখোঁচা খোঁচা দাড়ি,চোখে কালো ফ্রেমের চশমা ,চেহারায় এক অন্যরকম মায়া তারমানুষ মায়ার পাগল,মায়ায় পড়ে মানুষ নিজ জীবন কেউ তুচ্ছ করতর পারেঅসম্ভব কিছুই নয়

সময় যেন যাচ্ছেইনা,সেই সাথে মেয়েটিও আসছেনা
গতকাল এমন সময়েই মেয়েটিকে এই সামনের রাস্তাটায় পড়ে থাকতে দেখেছিলো সেএকটা চল্লিশ,বেয়ল্লিশ,তেতাল্লিশ,ছেচল্লিশকি করা যায় এখন? এভাবে ঘড়ি দেখে সময় কাটানো বিরক্তিকর ব্যাপার
হঠাৎ সে ভাবলো,মেঘ দেখলে কেমন হয়?সময় কাটানোর জন্য মেঘ দেখার মতো কাজটাকে অনির কাছে অনেক মূল্যবান মনে হলো
গাছের ফাকা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো অনিরোদেলা আকাশে চিকচিক করছে সাদা মেঘহঠাৎ সামনের পুকুরের দিকে
চোখ পড়তেই আরো ভালো লাগলো অনিরপানিতে মেঘ দেখা যায় এটা সে জানতো,কিন্তু এতোটা অপূর্ব!অনি মনে মনে মেঘের এই ব্যাপারটাকে কথা দিয়ে সাজালো,মেঘ অনেক সাধারণ আবার একইসাথে অসাধারণকারন মেঘ একই সাথে আকাশে ওড়ে আর টানিতে ভাসেসত্যিই অদ্ভুত

সময় তিনটা সতেরো
অনি সেই বেঞ্চিতেই বসে আছেমেয়েটি এখনো আসেনিআজকে আর আসবে বলেও মনে হচ্ছেনা অনিরক্লান্তভাব নিয়ে অনি বাসায় ফিরলো

সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল
এক রূপবতী নারী অনির সামনে রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলোআজ আর একটা বৃহস্পতিবারগতকাল পর্যন্ত অনি এই বেঞ্চিতে বসে ছিল দেড়টা থেকে সাড়ে তিনটাআজ শেষদিনের মতো অনি বসেছে ঐ মেয়েটির প্রতীক্ষায়এভাবে প্রতিদিন এক অপরিচিত মেয়ের জন্য বসে থেকে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়না

সময় দুটা তেরো
অনি তখন ঐ বেঞ্চিতে বসে গভীর মনোযোগে স্যান্ডেল দিয়ে অহেতুক খোঁচাচ্ছিলহয়তো তা অভ্যন্তরীণ ক্ষোভের বাহ্যিক প্রতিফলনএমন সময় এক নারীকন্ঠ ভেসে আসলো,

-আরে আপনি সেই লোকটা না?

অনি মাথা তুলে তাকাতেই চোখের সামনে সেই রূপবতীকে দেখতে পেলো
সে বুঝতে পারছেনা তার কি করা উচিতযার জন্য এই প্রতীক্ষা সে এখন তার সামনে দাড়িয়েমেয়েটি বললো,

-হুম. . .আ
পনিইতোতা আছেন কেমন?

-ভালো আছি
আপনি?

-আমিও ভালো
ও....নামটাই তো জানা হলোনাআমার নাম রিনাআপনার?

-অনিরুদ্ধ
অনিরুদ্ধ আহমেদ অনি

-খুব ভালো নাম
আমি কি এখানে বসতে পারি?

অনি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললো,

-হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই


এভাবেই শুরু হয়েছিলো দুটি জীবনের মিশে যাওয়া
অনি একদিন এই বেঞ্চিতে বসেই বলেছিল রিনাকে,

-দেখো রিনা,ঐ আকাশে
মেঘ দেখতে পাচ্ছো না?

-হুম
দেখতে পাচ্ছিসাদা সাদা মেঘ

-হ্যাঁ. . .জানো এই মেঘ অনেক অদ্ভুত


-কি?

-অদ্ভুত


-ও. . .

-বলতো কেন?

-অদ্ভুত তো আমার কাছে না,তোমার কাছে
তাহলে আমি কি করে বলি বলো?

-তাও ঠিক
কিন্তু অনুমানের চেষ্টাতো করো?আচ্ছা আমিই বলছি,মেঘ অদ্ভুতকারন কারন
  এটা আকাশে তো ওড়েই সাথে আবার পানিতেও ভাসেঐ দেখো. . .

-ও তাই?

-হুম. . .

-তাহলে কাক?

-কাক মানে?এখানে কাক আবার কোথা থেকে আসলো?

-তোমার কথা অনুসারে তো কাকেরও অদ্ভুত হওয়া উচিত
কারণ কাকও আকাশে ওড়ে সেই সাথে পানিতেও ভাসেঐ দেখো. . .

অনি মুখ গোমড়া করে ফেললো
সে কত সুন্দর একটা জিনিস ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো আর রিনা কিনা তার সাথে একটা কাককে তুলনা করলো?সে পুরো চুপ হয়ে রইলআর রিনা তার গোমড়া মুখ দেখে হাসতে থাকলো


তাদের যখন বিয়ে হয় অনির বয়স তখন চব্বিশদীর্ঘ ত্রিশ বছরের বৈবাহিক জীবন তাদেরদুজন দুজনের সার্থক ভালবাসানিজের মতো করেই দুজন দুজনকে পেয়েছিলোতাদের কোনো সন্তান-সন্ততি ছিলোনাতাতে তাদের তেমন কোনো দুঃখও নেইবরং অন্য ভুবনের এক আনন্দ এতে লুকিয়ে আছে
আজ চুয়ান্ন বছরের অনিরুদ্ধ সাহেব সেদিনের বাইশ বছরের অনির মত করেই ভালবাসেন রিনাকে
অনেক সুখী সে,সে সুখের কোনো অন্ত নেই,সাথে আছে ভালোলাগাটাও

তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের শত্রু থাকতে পারে,কিন্তু ভালবাসার কোনো শত্রু থাকেনা
তবে আজ কেন তার পাশে রিনা নেই?সবই তো আছে আগের মতআজও ঐ মেঘ আকাশে ওড়ছে,পানিতেও ভাসছেকাকটাও সেই একই কাজ করছেকোনোকিছুই তো বদলায়নিতবু কেন রিনা এই বৃদ্ধ বয়সে নেই তার পাশে?

তাদের ভালবাসার একটা শত্রু ছিলো
ক্যান্সার সেই শত্রু যার জন্য অনিরুদ্ধ সাহেব একা বসে আছেন এ বেঞ্চিটিতেঅনেকদিন ধরেই রিনা এককভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এই ক্যান্সারের সাথে তাদের ভালবাসাটিকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যক্যান্সার ধরা পড়ার পরও তারা এসেছেলো রমনায়এই বেঞ্চিতটিতেই পাশাপাশি বসেছিলো তারাএকবার নয়,বহুবারকিন্তু রিনা বুঝি আর পারলোনাযুদ্ধে যে ক্যান্সার পরাজিত করেই ছাড়বেডাক্তার আজই বলেছেন,

-অনিরুদ্ধ সাহেব
আমারও যে খুব কষ্ট হচ্ছেআর বেশীদিন নেইখুব বেশী হলে একসপ্তাহ. . .

অনিরুদ্ধ সাহেব শেষবারের মতো এক বৃহস্পতিবারে রমনায় নিয়ে এলেন রিনাকে
সেই বেঞ্চিটিতেই রোগা বৃদ্ধা রিনা আর অনিরুদ্ধ সাহেবতবে এবার তারা পাশাপাশি বসে নয়রিনার মাথা অনিরুদ্ধ সাহেবের কোলেঅনিরুদ্ধ সাহেব বললেন,

-দেখো রিনা
ঐআকাশে মেঘ দেখতে পাচ্ছো?

-কোথায় অনি?কোথায় মেঘ?আমি তো দেখতে পাচ্ছিনা. . .

-ঐ যে দেখো. . .সাদাসাদা মেঘগুলো আকাশে ওড়ছে আবার একই সাথে পানিতে ভাসছে
সাথে ঐ কাকটাওদেখো. . .

-অনি. . .অনি আমি সবকিছু অন্ধকার কেন দেখছি?কিছু বলছোনা কেন অনি?কিছু বলো?হঠাৎ অন্ধকার হলো কেমন করে?

আবারও সেই অসংজ্ঞায়িত ব্যাপার বোকা বানিয়ে দিলো অনিরুদ্ধ সাহেবকেতবে এবারের অসংজ্ঞায়িত ব্যাপারটা একটু অন্যরকমএবারে তো অন্ধকারটা অনিরুদ্ধ সাহেব দেখেননিঅন্ধকার দেখেছে রিনাতবুও এবারের অন্ধকারেও বোকা হতে হলো অনিরুদ্ধ সাহেবকেঅন্যের অন্ধকার দেখায় নিজের বোকা হওয়াটা কি অসংজ্ঞায়িত?অনিরুদ্ধ­ সাহেব অসংজ্ঞায়িত এ জগতে আর শ্বাস নিতে পারছেননাতার দমও বুঝি বন্ধ হয়ে এলোঠিক তখনি বুঝি তার কোলে শোয়া মৃত লাশটি তাকে অসংজ্ঞায়িত এ জগত থেকে মুক্ত করে বলে উঠলো,

-না অনি. . .এটা অসংজ্ঞায়িত নয়
তুমি তো দেখছি দিন দিন বোকা হয়ে গেছোএটা অবশ্যই সংজ্ঞায়িত এবং এরই নাম ভালোবাসা