আমাদের পরবর্তী সংখ্যায় লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের ফেসবুক পেজ এ ইনবক্স করুন অথবা ইমেইল করুন Ghuri2014@hotmail.com এই ঠিকানায়।

বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৫

একজন পুত্র কিংবা ভাইয়ের কথা - মামুন হাসান (৩য় সংখ্যা)

বাড়িটা বেশ পুরনো,বৃটিশ আমলের জমিদার বাড়িজমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু বছর আগেতবে কালের সাক্ষী হয়ে বাড়িটা রয়ে গেছে এখনো,মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে স্বগর্বে

.
আক্ষরিক অর্থেই বিশাল বাড়িটা গাছগাছালি দিয়ে ঘেরাচারপাশে উঁচু ইটের প্রাচীর,প্যালেস্তারা খসে খসে পড়ছে প্রতিনিয়তসামনে বড় লোহার গেটটা মরচে ধরে লালচে বাদামী রঙ ধারণ করেছেএককালে বাড়িটা বেশ রঙচঙে ছিল,এখন তার ছিটেফোঁটাও নেইরোদে পুড়ে পুড়ে হলুদাভ দেয়ালগুলো মলিন হয়ে গেছে,এখানে ওখানে শ্যাওলার পুরু স্তরে ঢেকে গেছেজানালার কাঁচগুলোতে ধুলার আস্তরণপ্রধান ফটক থেকে সদর দরজা পর্যন্ত ইট বিছানো রাস্তাটার ওপর শুকনো মড়া পাতার স্তূপএককালে যেখানে জমিদারের পত্নী কিংবা মেয়েরা শখ করে ফুলের বাগান করত,সেখানটায় এখন দীঘল সবুজ ঘাসবড় পুকুরটা ঢেকে আছে হলুদ জলজ শ্যাওলা আর ঝরাপাতা দিয়েশান বাঁধানো ঘাটলা দুটো ছেয়ে আছে ধুলাবালিতে,এখানে ওখানে দিয়ে বের হয়েছে লম্বা ঘাসবাড়ির ঠিক সামনে দিয়েই বয়ে চলেছে ছোট্ট একটি নদীআগে এ নদীটি ছিলনা,কালের বিবর্তনে নদী ভাঙ্গন হতে হতে একটি নদীর শাখা তৈরি হয়েছেভাঙ্গা গড়ার খেলা খেলতে খেলতে গিয়ে মিশেছে অন্য একটি নদীর সাথে
এক দুপুরে একটি ট্রলার এসে থামল জমিদার বাড়ির সামনেএকজন মাত্র যাত্রী নামল ট্রলার থেকে,অল্পবয়সী এক তরুণপরনে সাদা পাজামা আর হলুদাভ পাঞ্জাবী,চোখে চশমাচেহারায় একটা নির্লিপ্ত ভাব ধরে রেখেছে
ট্রলার থেকে নেমেই সে এগিয়ে চলল পুরনো পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে
মরচে পড়া লোহার গেটটা ছিটকিনি লাগানো তবে তালা মারা নয়কয়েকটা কাক বসে ছিল রডের মাথায়ছেলেটা গেট ধরে আস্তে করে একটা ঝাঁকুনি দেয়ার সাথে সাথেই সমস্বরে কা কা ধ্বনি তুলে কাকগুলো উড়ে গিয়ে কাছাকাছি থাকা একটা গাছের উপর গিয়ে বসলছিটকিনি খুলে গেটের গায়ে একটা ধাক্কা দিল ছেলেটি,ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে গেটটা ফাঁক হলো একটুসেই ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে
এটা তার পূর্বপুরুষদের বাড়ি
তবে খুব একটা যে এসেছে এখানে তা নয়এর আগে মাত্র একবার এসেছে সে এখানেতাও বহুদিন আগেবছরের হিসেব করলে প্রায় বিশ বছরছেলেটা তখন একেবারে ছোট,দুধের বাচ্চাকি ঘটেছির তখন সেটা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়সমস্ত ঘটনা সে তার মায়ের কাছ থেকে শুনেছে
তৎকালীন বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষ ছিল ইংরেজদের দখলেপ্রশাসনিক সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করেন

.
পূর্ব বাংলার মুসলমানরা এতে ব্যাপক খুশী হয় কিন্তু গোরা হিন্দুরা এটা ভাল চোখে দেখেনিতারা এর নাম দেয় বঙ্গভঙ্গপ্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর কবি সাহিত্যিকরা উঠে পড়ে লাগেন বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্যআন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে ধীরে ধীরেকঠোর আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ সরকার অবশেষে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে করতে বাধ্য হয়এ ঘটনা বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মনে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেএরই ফলশ্রুতিতে দুই ধর্মানুসারীদের মধ্যে বাঁধে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা"আল্লাহু আঁকবার" বলে হিন্দুদের গলায় ছুড়ি চালাত মুসলমানরা,অপরদিকে "বন্দে মাতরম" ধ্বনি তুলে মুসলমানদের জবাই করত হিন্দুরাচারদিকে তখন খুনির উল্লাস,মানুষের ভয়ার্ত চেহারায় তীব্র ঘৃণা,স্বজন হারানো মানুষের আহাজারির আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রতিশোধের আগুন
এই বাড়ির শেষ জমিদার শিবরাম ভট্টাচার্য তখন গ্রাম থেকে নিরীহ মুসলমান প্রজাদের ধরে এনে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠতেন
প্রচলিত আছে তিনি নাকি ঐ সময়ে প্রতিদিন মুসলমানদের রক্ত দিয়ে গোসল করতেনএই অত্যাচার বেশীদিন করতে পারেননি তিনিএক রাতে মুসলমানরা একজোট হয়ে হামলা করে জমিদার বাড়িতেবাড়ির সবাই মারা পড়ল
একমাত্র শিবরাম ভট্টাচার্য প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান কলকাতাবছর দশেক পর তিনি দেশে ফিরে আসেনততদিনে তার বাড়ির দখল নিয়ে নিয়েছে গ্রামের ক্ষমতাশীল মুসলিমরাতখন তিনি ঢাকার রায়েরবাজারে বসবাস করা শুরু করেনপাশাপাশি নিজ সম্পত্তি উদ্ধার করার জন্য মামলায় লড়েনবংশ রক্ষার জন্য তিনি একজন মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছিলেনসেখানে তার একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়শিবরাম তার ছেলের নাম রেখেছিলেন অরিন্দম ভট্টাচার্যকয়েক বছর পর তিনি মারা যানএরপর তার স্ত্রী অরিন্দমের নাম পাল্টে রাখেন সাইফুল ইসলামসাইফুলকে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে লাগলেন এবং সুশিক্ষিত করে তুললেনঅন্যদিকে মামলা লড়ছিলেন সমান তালেঅবশেষে মামলায় তারা জিতলেন এবং সম্পত্তি ফিরে পেলেনকিন্তু সাইফুলের কোন ধনসম্পদের প্রতি লোভ ছিল নাজমিদার বাড়ি থেকে অপসারিত হল অবৈধ দখলদাররা,কিন্তু বাড়িটা খালিই পড়ে রইল
তারপর দিন গেল,মাস গেল,বছর গেলসময় গড়াল অনেকদেখতে দেখতে সাইফুল হয়ে উঠল অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম,সাইফুল সাহেবততদিনে তার মা পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেতার ঘর তখন আলোকিত করে রেখেছে তার স্ত্রী আর দুই পুত্র সন্তান

.
দিনগুলো ভালই কাটছিল,একেবারে স্বপ্নের মতকিন্তু এই স্বপ্নের মধ্যেই একদিন দুঃস্বপ্ন এসে হানা দিলদিনটি ছিল বৃহস্পতিবার,২৫শে মার্চ ১৯৭১পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ংকরতম রাত্রি নেমে এসেছিল সেদিন সূর্যাস্তের পরহাজার হাজার ঘুমন্ত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল সেই কাল রাতে
সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সাইফুল সাহেব ও তার পরিবার
নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি ঢাকা থেকে গ্রামে চলে আসলেন,থাকতে শুরু করলেন প্রাসাদ-তুল্য বাড়িটায়
সাইফুল সাহেবের বড় ছেলেটার বয়স তখন আট বছর,ছোটটার চার মাস
এক রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন সবাই,শান্তির ঘুম
এক ঘরে সাইফুল সাহেব ও তার স্ত্রী ছিলেন ছোট ছেলেটাকে নিয়ে,পাশের ঘরে তাদের বড় ছেলে

মাঝরাতে হঠাৎ জেগে উঠলেন সাইফুল সাহেব
তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন কতগুলো পায়ের শব্দসিঁড়ি বেয়ে ওপরে আসছে কেউভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠল তারঅশুভ কিছুর ইঙ্গিত পেলেন তিনিফিসফিস শব্দ করে স্ত্রীকে ডেকে তুললেনততক্ষণে কতগুলো বুটের শব্দ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে বাজছিল তাদের কানেযথাসম্ভব আস্তে শব্দ করে ফিসফিস করে স্ত্রীকে বললেন ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতেপাশের ঘর থেকে অন্য ছেলেকে নিয়ে তিনি আসবেন তারপর
সাইফুল সাহেবের স্ত্রী এক মূহুর্ত সময়ও নষ্ট না করে বাচ্চা কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে
একটা গাছের আড়ালে গিয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি
বেশ কয়েক মিনিট কাটিয়ে দিলেন তিনি রুদ্ধশ্বাসেঅজানা ভয় যেন তাড়া করছে তাকেএবং তার আশংকা ই সত্য বলে প্রমাণিত হল যখন বাড়ির ভেতরে গুলির শব্দ হলএকটি দুটি তিনটি চারটি,চারবার গুলির শব্দ হলসাইফুল সাহেবের স্ত্রীর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল যেনবহুকষ্টে নিজেকে শান্ত রাখলেন তিনিএকবার ভাবলেন ভেতরে যাবেন,পরক্ষণেই আবার মত ঘুরিয়ে নিলেন
কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললেন
এক সন্তানকে বুকে আগলে রেখে অন্য সন্তান হারানোর বেদনা ভুলতে চাইলেন যেনরাতভর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেনসকালে সাহস করে এগোলেন বাড়ির দিকেলাশ দুটো দেখে কোন ভাবান্তর হলোনা তার মধ্যে,যেন যা কিছু হবার কথা ছিল তাই ঘটেছে
দীর্ঘ সময় কাটালেন তিনি স্বামী-সন্তানের লাশের পাশেলাশ দুটো সৎকার করার জন্য সারা গ্রাম খুঁজেও একটা লোক পাওয়া গেলনাজনশূন্য হয়ে গেছে গ্রামটিশেষে নিজেই অনেক কষ্টে গর্ত খুরে লাশদুটো মাটিচাপা দিলেন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই
.
তারপর কিছু টাকা পয়সা আর শুকনো খাবার নিয়ে পথ ধরলেন অজানার উদ্দেশ্যে
এরপর অতিবাহিত হলো অনেক সময়
অনেক চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে দেশ স্বাধীন হলো
সেইদিনের সেই ছোট বাচ্চাটা বড় হলো,মায়ের মুখ থেকে শুনল অতীত ইতিহাস,বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যু কাহিনী
তারপর একদিন চলে এলো তার পূর্বপুরুষের বাড়িতে,পরিত্যক্ত এই জমিদার বাড়িটিতে
বাড়ির আশপাশে হাটাহাটি করার সময় মায়ের মুখে শোনা কথাগুলো বারবার ঘুরেফিরে মনে হতে লাগলঅনেক খোঁজাখুঁজি করার পর কবরটা পেয়ে গেল সে,যেখানে ছেলেটার বাবা আর ভাইকে একসঙ্গে দাফন করেছিল তার মাকবরটা ছেয়ে গেছে ঘাস,ঘাসগুলো বড় বড়সে বুঝতে পারতোনা যে এটা একটা কবর যদিনা তার মা তাকে বলে দিত যে এখানে চিহ্ন হিসেবে কংক্রিটের একটা পিলার পোতা আছে
কবরে বারবার চুমু খেতে লাগল ছেলেটা
হাতের মুষ্টি ভরে মাটি নিয়ে মাখল গালে,কপালে,শরীরে
চিৎকার করে বলল,"বাবা,ভাইয়া তোমাদের দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি
তোমাদের কোলে ওঠার,তোমাদের গালে চুমু খাবার সৌভাগ্যও আমার হয়নিআমি পারিনি তোমাদের হাত ধরে হাটতে,পারিনি তোমাদের সাথে দুষ্টুমি করতেপারিনি চকলেট,আইসক্রিম কিংবা খেলনার জন্য বায়না ধরতেতোমাদের সাথে কোন কিছু করার সৌভাগ্যই আমার হয়নি
"আমার খুব ইচ্ছে করে তোমাদের সাথে একটু কথা বলি,বল কথা বলবে না আমার সাথে?
"আমি জানি তোমাদের ফিরে পাওয়া যাবে না
 তারপরও আমার ভাবতে খুব ভাল লাগে তোমাদের সাথে হাঁটছি,কথা বলছি,একসাথে টিভি দেখছি,গল্প করছি
"আচ্ছা তোমাদের ফিরে আসার কি কোন উপায়ই নেই ?যদি সম্ভব হয় তাহলে একটু দেখা দাও,আমি দুচোখ ভরে তোমাদের দেখব,
ছুঁয়ে দেব তোমাদেরদেখা দাও বাবা,দেখা দাও ভাইয়াএকটিবার,শুধুমাত্র একটিবারের জন্য লেও আমার সামনে আস...."
ছেলেটা শুয়ে পড়ল কবরের ওপর,কথার
ফুলঝুরি ছুটাতে লাগলবেলা শেষে সন্ধ্যা হলো,তারপর রাত,রাত শেষে ভোর হল,ছেলেটার কথা তবু ফুঁড়োয় না,চলতেই থাকে চলতেই থাকে.....

 



উৎসর্গ: মাশরাফি মর্তুজা
তোমাকে না দেখলে আমি বুঝতাম না দেশপ্রেম