বাড়িটা বেশ পুরনো,বৃটিশ আমলের জমিদার বাড়ি। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু বছর আগে। তবে কালের সাক্ষী হয়ে
বাড়িটা রয়ে গেছে এখনো,মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে
স্বগর্বে।
.
|
এক দুপুরে একটি ট্রলার
এসে থামল জমিদার বাড়ির সামনে। একজন মাত্র যাত্রী নামল ট্রলার থেকে,অল্পবয়সী
এক তরুণ। পরনে সাদা পাজামা
আর হলুদাভ পাঞ্জাবী,চোখে চশমা। চেহারায় একটা নির্লিপ্ত
ভাব ধরে রেখেছে।
ট্রলার থেকে নেমেই সে এগিয়ে চলল পুরনো পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে। মরচে পড়া লোহার গেটটা ছিটকিনি লাগানো তবে তালা মারা নয়। কয়েকটা কাক বসে ছিল রডের মাথায়। ছেলেটা গেট ধরে আস্তে করে একটা ঝাঁকুনি দেয়ার সাথে সাথেই সমস্বরে কা কা ধ্বনি তুলে কাকগুলো উড়ে গিয়ে কাছাকাছি থাকা একটা গাছের উপর গিয়ে বসল। ছিটকিনি খুলে গেটের গায়ে একটা ধাক্কা দিল ছেলেটি,ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে গেটটা ফাঁক হলো একটু। সেই ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।
এটা তার পূর্বপুরুষদের বাড়ি। তবে খুব একটা যে এসেছে এখানে তা নয়। এর আগে মাত্র একবার এসেছে সে এখানে। তাও বহুদিন আগে। বছরের হিসেব করলে প্রায় বিশ বছর। ছেলেটা তখন একেবারে ছোট,দুধের বাচ্চা। কি ঘটেছির তখন সেটা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সমস্ত ঘটনা সে তার মায়ের কাছ থেকে শুনেছে।
ট্রলার থেকে নেমেই সে এগিয়ে চলল পুরনো পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে। মরচে পড়া লোহার গেটটা ছিটকিনি লাগানো তবে তালা মারা নয়। কয়েকটা কাক বসে ছিল রডের মাথায়। ছেলেটা গেট ধরে আস্তে করে একটা ঝাঁকুনি দেয়ার সাথে সাথেই সমস্বরে কা কা ধ্বনি তুলে কাকগুলো উড়ে গিয়ে কাছাকাছি থাকা একটা গাছের উপর গিয়ে বসল। ছিটকিনি খুলে গেটের গায়ে একটা ধাক্কা দিল ছেলেটি,ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে গেটটা ফাঁক হলো একটু। সেই ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।
এটা তার পূর্বপুরুষদের বাড়ি। তবে খুব একটা যে এসেছে এখানে তা নয়। এর আগে মাত্র একবার এসেছে সে এখানে। তাও বহুদিন আগে। বছরের হিসেব করলে প্রায় বিশ বছর। ছেলেটা তখন একেবারে ছোট,দুধের বাচ্চা। কি ঘটেছির তখন সেটা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সমস্ত ঘটনা সে তার মায়ের কাছ থেকে শুনেছে।
তৎকালীন বাংলা তথা সমগ্র
ভারতবর্ষ ছিল ইংরেজদের দখলে। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করেন।
.
|
এই বাড়ির শেষ জমিদার শিবরাম ভট্টাচার্য তখন গ্রাম থেকে নিরীহ মুসলমান প্রজাদের ধরে এনে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠতেন। প্রচলিত আছে তিনি নাকি ঐ সময়ে প্রতিদিন মুসলমানদের রক্ত দিয়ে গোসল করতেন। এই অত্যাচার বেশীদিন করতে পারেননি তিনি। এক রাতে মুসলমানরা একজোট হয়ে হামলা করে জমিদার বাড়িতে। বাড়ির সবাই মারা পড়ল।
একমাত্র শিবরাম ভট্টাচার্য
প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান কলকাতা। বছর দশেক পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ততদিনে তার বাড়ির দখল
নিয়ে নিয়েছে গ্রামের ক্ষমতাশীল মুসলিমরা। তখন তিনি ঢাকার রায়েরবাজারে বসবাস করা শুরু করেন। পাশাপাশি নিজ
সম্পত্তি উদ্ধার করার জন্য মামলায় লড়েন। বংশ রক্ষার জন্য তিনি একজন মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছিলেন। সেখানে তার একটি
পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। শিবরাম তার ছেলের নাম রেখেছিলেন অরিন্দম ভট্টাচার্য। কয়েক বছর পর তিনি মারা যান। এরপর তার স্ত্রী অরিন্দমের নাম পাল্টে রাখেন সাইফুল ইসলাম। সাইফুলকে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে লাগলেন এবং সুশিক্ষিত করে
তুললেন। অন্যদিকে
মামলা লড়ছিলেন সমান তালে। অবশেষে মামলায় তারা জিতলেন এবং সম্পত্তি ফিরে পেলেন। কিন্তু সাইফুলের কোন ধনসম্পদের প্রতি
লোভ ছিল না। জমিদার বাড়ি থেকে অপসারিত হল অবৈধ দখলদাররা,কিন্তু বাড়িটা খালিই পড়ে রইল।
তারপর দিন গেল,মাস গেল,বছর গেল। সময় গড়াল অনেক। দেখতে দেখতে
সাইফুল হয়ে উঠল অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম,সাইফুল
সাহেব। ততদিনে তার মা
পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। তার ঘর তখন আলোকিত করে রেখেছে তার স্ত্রী আর দুই পুত্র সন্তান।
.
|
সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সাইফুল সাহেব ও তার পরিবার। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি ঢাকা থেকে গ্রামে চলে আসলেন,থাকতে শুরু করলেন প্রাসাদ-তুল্য বাড়িটায়।
সাইফুল সাহেবের বড় ছেলেটার বয়স তখন আট বছর,ছোটটার চার মাস। এক রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন সবাই,শান্তির ঘুম।
এক ঘরে সাইফুল সাহেব ও তার স্ত্রী ছিলেন ছোট ছেলেটাকে নিয়ে,পাশের ঘরে তাদের বড় ছেলে।
মাঝরাতে হঠাৎ জেগে উঠলেন সাইফুল সাহেব। তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন কতগুলো পায়ের শব্দ। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে আসছে কেউ। ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠল তার। অশুভ কিছুর ইঙ্গিত পেলেন তিনি। ফিসফিস শব্দ করে স্ত্রীকে ডেকে তুললেন। ততক্ষণে কতগুলো বুটের শব্দ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে বাজছিল তাদের কানে। যথাসম্ভব আস্তে শব্দ করে ফিসফিস করে স্ত্রীকে বললেন ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে। পাশের ঘর থেকে অন্য ছেলেকে নিয়ে তিনি আসবেন তারপর।
সাইফুল
সাহেবের স্ত্রী এক মূহুর্ত সময়ও নষ্ট না করে বাচ্চা কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ির
পেছনের দরজা দিয়ে।
একটা গাছের আড়ালে গিয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। বেশ কয়েক মিনিট কাটিয়ে দিলেন তিনি রুদ্ধশ্বাসে। অজানা ভয় যেন তাড়া করছে তাকে। এবং তার আশংকা ই সত্য বলে প্রমাণিত হল যখন বাড়ির ভেতরে গুলির শব্দ হল। একটি দুটি তিনটি চারটি,চারবার গুলির শব্দ হল। সাইফুল সাহেবের স্ত্রীর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল যেন। বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত রাখলেন তিনি। একবার ভাবলেন ভেতরে যাবেন,পরক্ষণেই আবার মত ঘুরিয়ে নিলেন।
কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললেন। এক সন্তানকে বুকে আগলে রেখে অন্য সন্তান হারানোর বেদনা ভুলতে চাইলেন যেন। রাতভর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। সকালে সাহস করে এগোলেন বাড়ির দিকে। লাশ দুটো দেখে কোন ভাবান্তর হলোনা তার মধ্যে,যেন যা কিছু হবার কথা ছিল তাই ঘটেছে।
দীর্ঘ সময় কাটালেন তিনি স্বামী-সন্তানের লাশের পাশে। লাশ দুটো সৎকার করার জন্য সারা গ্রাম খুঁজেও একটা লোক পাওয়া গেলনা। জনশূন্য হয়ে গেছে গ্রামটি। শেষে নিজেই অনেক কষ্টে গর্ত খুরে লাশদুটো মাটিচাপা দিলেন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই।
.একটা গাছের আড়ালে গিয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। বেশ কয়েক মিনিট কাটিয়ে দিলেন তিনি রুদ্ধশ্বাসে। অজানা ভয় যেন তাড়া করছে তাকে। এবং তার আশংকা ই সত্য বলে প্রমাণিত হল যখন বাড়ির ভেতরে গুলির শব্দ হল। একটি দুটি তিনটি চারটি,চারবার গুলির শব্দ হল। সাইফুল সাহেবের স্ত্রীর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল যেন। বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত রাখলেন তিনি। একবার ভাবলেন ভেতরে যাবেন,পরক্ষণেই আবার মত ঘুরিয়ে নিলেন।
কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললেন। এক সন্তানকে বুকে আগলে রেখে অন্য সন্তান হারানোর বেদনা ভুলতে চাইলেন যেন। রাতভর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। সকালে সাহস করে এগোলেন বাড়ির দিকে। লাশ দুটো দেখে কোন ভাবান্তর হলোনা তার মধ্যে,যেন যা কিছু হবার কথা ছিল তাই ঘটেছে।
দীর্ঘ সময় কাটালেন তিনি স্বামী-সন্তানের লাশের পাশে। লাশ দুটো সৎকার করার জন্য সারা গ্রাম খুঁজেও একটা লোক পাওয়া গেলনা। জনশূন্য হয়ে গেছে গ্রামটি। শেষে নিজেই অনেক কষ্টে গর্ত খুরে লাশদুটো মাটিচাপা দিলেন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই।
এরপর অতিবাহিত হলো অনেক সময়। অনেক চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে দেশ স্বাধীন হলো।
সেইদিনের সেই ছোট বাচ্চাটা বড় হলো,মায়ের মুখ থেকে শুনল অতীত ইতিহাস,বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যু কাহিনী। তারপর একদিন চলে এলো তার পূর্বপুরুষের বাড়িতে,পরিত্যক্ত এই জমিদার বাড়িটিতে।
বাড়ির আশপাশে
হাটাহাটি করার সময় মায়ের মুখে শোনা কথাগুলো বারবার ঘুরেফিরে মনে হতে লাগল। অনেক খোঁজাখুঁজি
করার পর কবরটা পেয়ে গেল সে,যেখানে ছেলেটার বাবা আর ভাইকে একসঙ্গে দাফন
করেছিল তার মা। কবরটা ছেয়ে গেছে ঘাস,ঘাসগুলো বড় বড়। সে বুঝতে পারতোনা যে এটা একটা কবর যদিনা তার মা তাকে
বলে দিত যে এখানে চিহ্ন হিসেবে কংক্রিটের একটা পিলার পোতা আছে।
কবরে বারবার চুমু খেতে লাগল ছেলেটা। হাতের মুষ্টি ভরে মাটি নিয়ে মাখল গালে,কপালে,শরীরে।
চিৎকার করে বলল,"বাবা,ভাইয়া তোমাদের দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তোমাদের কোলে ওঠার,তোমাদের গালে চুমু খাবার সৌভাগ্যও আমার হয়নি। আমি পারিনি তোমাদের হাত ধরে হাটতে,পারিনি তোমাদের সাথে দুষ্টুমি করতে। পারিনি চকলেট,আইসক্রিম কিংবা খেলনার জন্য বায়না ধরতে। তোমাদের সাথে কোন কিছু করার সৌভাগ্যই আমার হয়নি।
কবরে বারবার চুমু খেতে লাগল ছেলেটা। হাতের মুষ্টি ভরে মাটি নিয়ে মাখল গালে,কপালে,শরীরে।
চিৎকার করে বলল,"বাবা,ভাইয়া তোমাদের দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তোমাদের কোলে ওঠার,তোমাদের গালে চুমু খাবার সৌভাগ্যও আমার হয়নি। আমি পারিনি তোমাদের হাত ধরে হাটতে,পারিনি তোমাদের সাথে দুষ্টুমি করতে। পারিনি চকলেট,আইসক্রিম কিংবা খেলনার জন্য বায়না ধরতে। তোমাদের সাথে কোন কিছু করার সৌভাগ্যই আমার হয়নি।
"আমি জানি তোমাদের ফিরে পাওয়া যাবে না। তারপরও আমার ভাবতে খুব ভাল লাগে তোমাদের সাথে হাঁটছি,কথা বলছি,একসাথে টিভি দেখছি,গল্প করছি।
"আচ্ছা তোমাদের ফিরে আসার কি কোন উপায়ই নেই ?যদি সম্ভব হয় তাহলে একটু দেখা দাও,আমি দুচোখ ভরে তোমাদের দেখব,ছুঁয়ে দেব তোমাদের। দেখা দাও বাবা,দেখা দাও ভাইয়া। একটিবার,শুধুমাত্র একটিবারের জন্য হলেও আমার সামনে আস...."
ছেলেটা শুয়ে পড়ল কবরের ওপর,কথার ফুলঝুরি ছুটাতে লাগল। বেলা শেষে সন্ধ্যা হলো,তারপর রাত,রাত শেষে ভোর হল,ছেলেটার কথা তবু ফুঁড়োয় না,চলতেই থাকে চলতেই থাকে.....
উৎসর্গ: মাশরাফি মর্তুজা
তোমাকে না দেখলে আমি বুঝতাম না দেশপ্রেম
|